fbpx

বাস্তু শাস্ত্র ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি

বাস্তুশাস্ত্র যে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক এক ভাবনা, এই লেখায় সে কথাই বিশ্লেষণ করে দেখানো হবে।‘দিক’ এবং ‘সৌরশক্তি’ ছাড়াও বাস’শাস্ত্র অনুযায়ী গৃহনির্মাণ কীভাবে মহাজাগতিক রশ্মির কম্পনের উপর নির্ভরশীল এই লেখায় বিশ্লেষিত হয়েছে সেই প্রসঙ্গও।আমাদের প্রাচীন মুসলিম জ্ঞানী-গুণীরা বাস’শাস্ত্রের জনক।তাঁদের অতীন্দ্রিয় কল্পনাশক্তি এবং অন্তদর্শনের ফসল হল বাস্তু।বলা বাহুল্য, মানবসমাজ এবং স্থাপত্যের ওপরে ব্রহ্মান্ডের মহাজাগতিক শক্তির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রভাব মুসলমান জ্ঞানী-গুণীদের অজানা ছিল না।স্বীয় সাধনার শক্তিতে নিখিল বিশ্বের ওই রহস্যময় শক্তিগুলির সম্যক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তাঁরা।নিউটনের আবির্ভাবের পূর্বে পশ্চিম দুনিয়ার বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীতে মনুষ্য অথবা প্রকৃতিসৃষ্ট অস্থায়ী শক্তি ব্যতীত অন্য কোনও শক্তির সম্ভাবনা।পবিত্র কোরআন শরীফ এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন।

নিউটন এই পার্থিব শক্তির নাম দেন গ্রাভিটেশন বা মাধ্যাকর্ষণ।যদিও নিউটন সপ্তদশ শতাব্দীতে এই মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব আবিষ্কার করে আধুনিক জগৎকে চমকে দেন , তবুও আশ্চর্যের ব্যাপার নিউটনের আবিষ্কারের প্রায় বহু বছর আগে কোরআন শরীফে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন।পৃথিবীর নিজস্ব আকর্ষণ শক্তি আছে।যে কোনও গুরু অর্থাৎ ভারী বস্তুকে সে তার কেন্দ্রে আকর্ষণ করে।

আধুনিক পশ্চিমি গণিতশাস্ত্র মুসলিম গণিতশাস্ত্রের কাছে অশেষ ঋণী।শূন্যের আবিস্কার থেকে দশমিকের আবিস্কার সবই মুসলমান গণিতজ্ঞদের কৃতিত্ব।বহু আরবী গ্রন্থে বৃত্ততত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়।পৃথিবীর বুকে মাধ্যাকর্ষণই একমাত্র শক্তি নয়।একাধিক চৌম্বকীয় এবং তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।তাঁদের মতে, অগণিত ‘কম্পন’ পৃথিবীর বুকে ক্রিয়াশীল।সামপ্রতিক পরীক্ষা থেকে দেখা গিয়াছে, এই মহাজাগতিক কম্পনগুলির উৎস এক ও অভিন্ন।এরই উৎস থেকে বিকীর্ণ হয়ে মহাজাগতিক শক্তি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে।মুসলমান মনীষীগণ ভূপৃষ্ঠে এই মহাজাগতিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হলেও, পশ্চিমি সমাজকে এ ব্যাপারে অবহিত করার কৃতিত্ব এক জার্মান বিজ্ঞানী ড. এর্মেজ হার্টম্যান-এর।ড. হার্টম্যান ভূপৃষ্ঠের গায়ে তারের জালির মতো লেগে থাকা একগুচ্ছ রশ্মি আবিষ্কার করেন।ধনাত্মক এবং ঋণাত্বক আধারযুক্ত এই রশ্মিগুলি উল্লম্বভাবে ভূমি থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে – অনেকটা তেজস্ক্রিয় প্রাচীরের ধাঁচে।প্রতিটির ঘনত্ব ২১ সেন্টিমিটার।উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রতি ২ মিটার অন্তর এই ধরণের রশ্মি বিকিরণ হয়।মিশরে চিপোর পিরামিডের গাণিতিক বীজগুলির সঙ্গে এই মহাজাগতিক রশ্মিগুচ্ছের অত্যাশ্চর্য মিল রয়েছে।এর্মেজ হার্টম্যান এও আবিস্কার করেন যে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মিগুলি পরস্পর ছেদ করে।এই ছেদবিন্দুগুলি মানবদেহের ওপর অত্যন্ত অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে।কয়েকটি ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে ‘হার্টম্যান নেটওয়ার্ক’-এর ছেদবিন্দু।অন্যান্য পারিপার্শ্বিক প্রভাব (শারীরিক, পরিবেশগত ইত্যাদি) ছাড়াও বাস্তুশাস্ত্রে ভূমি থেকে নির্গত হয়ে ভূমণ্ডল পরিবেষ্টনকারী এই শক্তির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

আমাদের জীবন নির্ভর করে প্রকৃতির পাঁচটি শক্তি- সূর্যের বিকিরণ,পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র,মাধ্যাকর্ষণ,বাতাসের গতিবেগ এবং মহাজাগতিক শক্তি সমুহের উপর।সূর্যের রশ্মি হল তড়িৎ চ্চুম্বকীয় বিকিরণ।এই বিকিরণ ব্যাপ্তি সুদুর বিসতৃত ক্ষেত্রে,তা মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বেতার তরঙ্গেও,সূর্যরশ্মির একটি সামান্য অংশ যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই এবং যা সাদা রঙের, পিছনে লুকিয়ে আছে রামধনুর সাত রং-বেনীআসহকলা (Vibgyor)।এই রংগুলি হল বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল।আসলে রংগুলি রয়েছে বেগুনি থেকে লালের মধ্যেই।বেগুনি রঙের থেকে বেশি ক্ষমতার রশ্মিকে বলে অতিবেগুনি (Ultraviolet) রশ্মি।আর লাল রঙের থেকে বেশি ক্ষমতার রশ্মিকে বলে লাল উজানি (Infrared) রশ্মি।মানুষের জীবনে লাল উজানি রশ্মি অতি প্রয়োজনীয়।এই রশ্মির সাহায্যে প্যারালিসিস, পেশির বেদনা ও নানাবিধ রোগের উপশম সম্ভব।অথচ অতিবেগুনি রশ্মি মানুষের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর।এই অতিবেগুনি রশ্মির কারণে দেহে জিনঘটিত নানা রোগ সৃষ্টি তো হয়ই সেই সঙ্গে বিভিন্ন চর্মরোগ সৃষ্টি করে।আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সূর্যরশ্মি বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশদ আলোচনা আছে।আমরা জানি যে ছবি তোলার সময় সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে বাঁচতে আলট্টাভায়োলেট ফিল্টার (UV Filter)ব্যবহার করেন ফটোগ্রাফাররা।

ব্স্তুশাস্ত্রের মূল কথাই হল, কেমন করে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে মানবজীবনকে রক্ষা করে উপকারী লাল উজানি রশ্মির সুফল লাভ করা যায়।সেই কারণে বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বাড়িতে অতিবেগুনি রশ্মি না ঢুকতে পারে।বরং লাল উজানি রশ্মির যাতায়াত অবাধ হয়।যেহেতু লাল উজানি রশ্মি আসে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সেই কারণে ব্স্তুশাস্ত্রে বাড়ির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে বেশি খোলা রাখতে বলা হয়েছে।আবার অতিবেগুনি রশ্মি দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বেশি পরিমাণে আসে বলে বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমদিকটিকমখোলারাখারনির্দেশদিয়েছেব্স্তুশাস্ত্র।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।এ সবের জন্যেই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল বা সমুদ্রে এবং নদীতে তৈরি হচ্ছে ঢেউ।প্রাণিজগতের ওপরও এই সমস্ত প্রভাব সদাসর্বদাই পড়ছে।জীবনের ওপর প্রভাব, বিশেষ করে মানবজীবনের ওপর প্রভাব নিয়েই জ্যোতিষশাস্ত্র বা জ্যোতির্বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে।জ্যোতিষশাস্ত্র সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু, কেতু ইত্যাদি গ্রহের এবং রাশির সঙ্গে সম্পর্কিত।গ্রহনক্ষত্র এবং রাশিচক্র পৃথিবীর জীবনের ওপর প্রভাবিত।আকাশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শব্দ।

আমরা জানি যে পৃথিবী নিজেই একটি বৃহৎ চুম্বক।চুম্বকের ধর্ম হল তাকে যদি খণ্ড খণ্ড করে হাজার টুকরো করা যায় তবে প্রতিটি খণ্ডই একটি চুম্বকে পরিণত হয় যাতে চুম্বকীয় ধর্মগুলি বিদ্যমান থাকে।অনুরূপে সমগ্র পৃথিবীকে শত-সহস্র খণ্ডে বিভক্ত করলে প্রতিটি খণ্ডেই চুম্বকীয় ধর্ম থাকবে।তাই একটি বিশাল আকারের জমি হোক বা অতি ক্ষুদ্র প্লটই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিটি জমিতে থাকবে চুম্বকের গুণাবলি।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু থেকেই যার যার নিজস্ব তরঙ্গে প্রতিনিয়ত শক্তি বিকিরণ হয়।কেবলমাত্র কঠিন, তরল, গ্যাসের থেকেই নয়, প্রতিটি অণু, তন্তু ও কোষ থেকেও শক্তি বিকিরিত হয়।কিছু বস্তু থেকে বিকিরিত হয় ধনাত্মক শক্তি, আবার কিছু থেকে ঋণাত্মক শক্তি।যে সমস্ত বস্তু থেকে ধনাত্মক শক্তি বিকিরিত হয় সেগুলি উপকারী।আর যে সমস্তু বস্তু থেকে ঋণাত্মক শক্তি বিকিরণ হয় সেগুলি ক্ষতিকর।বস্তু থেকে বিকিরিত ক্ষতিকর ঋণাত্মক শক্তিকে কেমনভাবে প্রতিহত করা যায় তারও নির্দেশ আছে বাস’শাস্ত্রে।সেটিই বাস্তুকলা।আমাদের চারপাশে যে সমস্ত বস্তু বিরাজ করে তার মধ্যে বেশ কিছু ধনাত্মক শক্তিসম্পন্ন এবং বেশ কিছুর রয়েছে ঋণাত্মক শক্তি।আমি পূর্বেই বলেছি ঋণাত্মক শক্তিসম্পন্ন বস্তু ক্ষতিকারক।কাজেই এই ঋণাত্মক শক্তিসম্পন্ন বস্তু গুলিকে পরিহার করে চলা উচিত।ধনাত্মক শক্তিসম্পন্ন বস্তুর উদাহরণ হল- পিতল, ক্রিস্টাল, চিনামাটি, সিরামিক, বেশ কিছু পাথর, সুরকি, কাঠ, গাছপালা ইত্যাদি।আর ঋণাত্মক বস্তুসকল হল লোহা, অ্যাক্রিলিক, পলিতিন, নাইলন, পিভিসি, সিন্থেটিক ভিনাইল, গ্রানাইট ইত্যাদি।এই ঋণাত্মক বস্তু সকল পরিহার করলে ভাল।আর ধনাত্মক বস্তু সকল জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই উপকারী।ঋণাত্মক শক্তি সিরোটিনিন ও হিস্টামাইন উৎপন্নণ করে মানবদেহে।যার ফলে অসুস্থতা সৃষ্টি হয় এবং জীবনীশক্তি কমিয়ে দিয়ে হতাশা বাড়ায়।

বাড়ির নকশা করার সময় বাতাসের গতিবেগের কথা মাথায় রাখা অবশ্য প্রয়োজনীয় কেননা বাতাসের গতিবেগ ও দিকনির্দেশ নির্ভর করে সূর্যের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের উপর।তাই চেরাপুঞ্জি প্রবাহিত হাওয়ার গতিবেগ ও সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের হাওয়ার গতিবেগ এক নয়।চেরাপুঞ্জির বাতাসের গতিবেগ পর্বত উপকূলবর্তী বলে অনেক বেশি।আর বৃষ্টিও বেশি।তাই চেরাপুঞ্জির বাড়ির ছাদ ঢালু করা হয়।সমগ্র সাহারা অঞ্চলে এর বিপরীত চিত্র।ছাদের তল করা হয় সমতল।

সূর্যকিরণ সারাদিন ধরে পাই, রাতে পাই না।কিন্তু মহাজাগতিক রশ্মি ২৪ ঘণ্টা ধরেই চলে।অথচ খালি চোখে তা দৃশ্যমান নয়।এই মহাজাগতিক রশ্মিকে বাস্তু পরিকল্পনার সাহায্যে একত্রিত করে মানবজীবনের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়।মজার কথা হল বাস’শাস্ত্রে জমি-বাড়ির সকল ত্রুটি থেকে মুক্তির উপায়ও বলা আছে।আর সেই উপায় খোঁজা যায় অভিজ্ঞ বাস্তুশাস্ত্রীর মাধ্যমে।বাস্তু শুধু কোন দেশের নির্দিষ্ট স্থাপত্যবিদ্যা নয়, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শাস্ত্র।

বলা বাহুল্য, বাস্তুশাস্ত্র শিল্প, বিজ্ঞান, গ্রহবিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং অতীন্দ্রিয়বাদেরই সমন্বয়।মানব সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারকারী অন্যান্য বিষয় যেমন আবহাওয়া, তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বাতাসের গতি ও অভিমুখ, রৌদ্রালোক, আদ্রতা, তেজস্ক্রিয়তা, সময়, মহাশূন্য এবং বাসস্তুস্থানের চর্চার অপর নাম বাস্তুশাস্ত্র।হিন্দু শাস্ত্রে এই মহাজাগতিক শক্তিপুঞ্জকে ‘মহাভূত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।এই কম্পন এবং পৃথিবীর পঞ্চতত্ত্বই (ক্ষিতি, অপু, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) বিভিন্ন মহাজাগতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জন্য দায়ী।এইগুলি মানব সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করাই বাস্তুশাস্ত্রের লক্ষ্য।